মো: রাসেল মোল্লা
রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ)সংবাদদাতা :
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান পদে এবারের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন -৫ জন। ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪ মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এদের মধ্যে ক্যাসিনো কান্ডের সেলিম প্রধান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে আলোচনায় এসেছেন। চেয়ারম্যান প্রার্থীরা হলেন, রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের কার্যকরী পরিষদের সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব, ক্যাসিনো কান্ডের সেলিম প্রধান, রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তাবিবুল কাদির তমাল, রূপগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু হোসেন ভুঁইয়া রানু, রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি গাজী গোলাম মূর্তজা পাপ্পা। ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীরা হলেন, এডভোকেট স্বপন ভুঁইয়া, রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান হারেজ, স্থানীয় তাঁতীলীগ নেতা রাসেল আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য মিজানুর রহমান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীরা হলেন, রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলা, রূপগঞ্জ উপজেলা যুব মহিলালীগের সভাপতি ফেরদৌসী আক্তার রিয়া, রূপগঞ্জের দাউদপুর ইউনিয়ন মহিলালীগের সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌসী জান্নাত রুমা ও স্থানীয় যুব মহিলালীগ নেত্রী তানিয়া তুলতানা।
দুদক বলছে, অনুসন্ধানের সময় রাজধানীর ধানমন্ডি, গুলশান, উত্তরা, বনানীসহ একাধিক জায়গায় তাঁর বাড়ি ও ফ্ল্যাট আছে, যার বাজারমূল্য শতাধিক কোটি টাকা, যা তাঁর আয়কর নথিতে প্রদর্শন করা হয়নি।
জানা গেছে, সেলিম প্রধান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় চার বছর সাজাও খেটেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আরও তিনটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন। অনলাইন ক্যাসিনোর মূল হোতা সাজাপ্রাপ্ত সেলিম প্রধান এবার উপজেলা নির্বাচনে ইতিমধ্যে গণসংযোগ করেছেন ও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১ লক্ষ টাকা অনুদান প্রদান করে বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন।
২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থাইল্যান্ডগামী বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে নামিয়ে এনে সেলিম প্রধানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাঁকে নিয়ে তাঁর অফিস ও বাসায় অভিযান চালিয়ে ২৯ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা, ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকার সমপরিমাণ ২৩টি দেশের মুদ্রা, ১২টি পাসপোর্ট, ১৩টি ব্যাংকের ৩২টি চেক, ৪৮ বোতল বিদেশি মদ, একটি বড় সার্ভার, চারটি ল্যাপটপ ও দুটি হরিণের চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে। হরিণের চামড়া উদ্ধারের ঘটনায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ নিরাপত্তা আইনে তাঁকে ছয় মাসের কারাদন্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তাঁর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও মানি লন্ডারিং আইনে দু’টি মামলা হয়।
অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসার হোতা সেলিম প্রধানের নামে বেনামে প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তবে প্রাথমিক অনুসন্ধানে সেলিমের ১২ কোটি ২৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ পেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান এ মামলা করেন। থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসা চালিয়ে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। ২০১৮ সালে ক্যাসিনো মার্কেট পি-২৪ লিমিটেড নামে গেমিং কোম্পানি গঠন করেন সেলিম।
সেলিম প্রধান রূপালী ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপি হয়েছেন। অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসাসহ অন্যান্য অনৈতিক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে প্রতি মাসে অন্তত ১০০ কোটি টাকা বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন।
সেলিম প্রধানের ২০১৮-২০১৯ করবষের্র আয়কর নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, তাঁর নিজ নামে ১১ কোটি ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৬১৮ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে কোম্পানির পরিচালক হিসেবে শেয়ারে বিনিয়োগ ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা, এফডিআর বিনিয়োগ ৬ কোটি ১২ লাখ ১৫ হাজার, সঞ্চয়পত্র কেনায় ব্যয় ৭৬ লাখ ৬২ হাজার এবং হাতে নগদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত হিসেবে ঘোষিত ৬ লাখ ২৮ হাজার ৬১৮। এই টাকা অর্জনের পক্ষে কোনো সুনির্দিষ্ট বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া তাঁর ২০ লাখ টাকা স্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। বিএফআইইউ থেকে পাওয়া রেকর্ডে তাঁর বিভিন্ন ব্যাংকে ৫৪ লাখ ৫০ হাজার ১৩৬ টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়, যা তিনি আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি। সব মিলিয়ে সেলিমের ১২ কোটি ২৭ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫৪ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে, যার পক্ষে কোনো সুনির্দিষ্ট বৈধ আয়ের উৎস নেই।
প্রথমে সেলিম প্রধান বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনো চালু করেন। তিনি গুলশান ও বনানীতে পি-২৪ এবং টি-২১ অনলাইন নামে অনলাইনে ভিডিও গেম খেলার প্লাটফর্ম চালু করেন। ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর সেগুলোকে অনলাইন ক্যাসিনোয় রূপান্তর করেন। ওই অনলাইন ক্যাসিনোর প্রধান কেন্দ্র ছিল ফিলিপাইনে।
সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা ছাড়াও ঢাকার গুলশান থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে তিনটি মামলা হয়। বিচারাধীন এসব মামলায় জামিনে রয়েছেন তিনি। ২০২৩ সালের ৩০ এপ্রিল দুদকের করা মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। তাতে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের দুই ধারায় সেলিম প্রধানকে চার বছর করে কারাদন্ড দেন আদালত। ইতিমধ্যে তাঁর সাজাভোগ শেষ হওয়ায় এবং বাকি মামলায় জামিন পাওয়ায় গত বছরের অক্টোবরে মুক্তি পান তিনি। সাজার বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে যে আপিল করেছেন, সেটা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রায়ে বলেছেন, কোনো ব্যক্তির দুই বছরের বেশি দন্ড ও সাজা হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সাজা স্থগিত থাকলেও নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে না; যদি সাজা উপযুক্ত আদালতে বাতিল না হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অতীতে সাজাপ্রাপ্ত হলেও আপিল করে নির্বাচন করতে পারতেন। কিন্তু হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী এখন মনে হয়