নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীর ভাষানটেক ও কাফরুল এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় একটি দখল চক্র । স্থানীয়দের নিকট এই চক্রটি একটি মূর্তিমান আতঙ্ক। এলাকাবাসীর ভাষায়, “যেখানে দখল, সেখানেই তাদের নাম।” অভিযোগ রয়েছে, কুখ্যাত সন্ত্রাসী ‘কালা জাহাঙ্গীর’ ও ‘কিলার ইব্রাহীম’- এর নাম বিক্রি করে এই চক্রে মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় রয়েছে,কালা ইব্রাহীম, জনি দেওয়ান, হাফিজুল বাবু, সালমা ভান্ডারী, লিমা, নুরজাহান নূরী, মানিক ওরফে স্ট্যান্ড মানিক, যুবরাজ, রুপচাঁদ, শাকিল, রাসেল, জাহিদ,রনি, ফারুক, শফিক, মো: মজিবর রহমান, মো: সাগর ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা।
এই চক্রের বিরুদ্ধে জমি দখল, চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, জাল দলিল তৈরি, অবৈধ বস্তি গড়ে তোলা, এমনকি প্রকাশ্যে অপকর্ম, রাতের অন্ধকারে ভয়াবহ হামলা ও লুপপাটের অভিযোগ রয়েছে বহু বছর ধরে। সূত্র জানায়, এদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত অসংখ্য মামলা ও অভিযোগ দায়ের হয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
২০২২ সালের এপ্রিল মাসের ২২ তারিখে এস এম আনোয়ার হোসেন (অবসর প্রাপ্ত সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার) নিজে বাদী হয়ে বিজ্ঞ ১ম সহকারী জজ আদালতে দেওয়ানী মামলা দায়ের করেন, যার মামলা নং- ৪৬৩/২২। সেই মামলায় জমি দখলের অভিযোগ এনে আসামি করা হয় (০১) মো: হাসান আলী (০২) ইব্রাহীম (০৩) মোখলেছ (০৪) সালমা ভান্ডারীকে। এছাড়া বেলায়েত হোসেন নামের একজন ব্যাংক কর্মকর্তা ওই সব ভুমিদস্যু ও চাঁদাবাজদের যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ হয়ে একাধিক অভিযোগ ও মামলা দায়ের করেন। ভাষানটেক থানা মামলা নং- ১২ (০২) ২০২৪ ইং, ভাষানটেক থানা, জিডি নং- ৩১৭,তারিখ- ১৬/০৩/২০২৪ ইং, নন-জিআর নং- ৬৫৩/২৪,ভাষানটেক থানা জিডি নং- ৬৮১/২৪,নন-জিআর নং- ৪০/২৫, ভাষানটেক থানা, জিডি নং- ৬৮১,তারিখ- ১৫/১২/২০২৪ ইং, ভাষানটেক থানা, জিডি নং- ১১২,তারিখ- ০৩/০৭/২০২৫ ইং তবে এসব মামলা/জিডি কোনোটিরই দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি কোন কালেই। তদন্ত চলছে এই অজুহাতে বছরের পর বছর পার হলেও, দখলদারদের দৌরাত্ম্য কেবল বেড়েই চলেছে।
আওয়ামী ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের কাফরুল থানা ৪নং ওয়ার্ড এর যুগ্ন-সাধারণ সম্পাদক ডি এস পি বাবুর দখলকৃত অসংখ্য বাড়ি,প্লট,অবৈধ গ্যাস সংযোগ,বিদ্যুৎ,পানির লাইন সবকিছুই এখন হাফিজুল বাবু ও জনি দেওয়ানের কবজায়।
কাফরুল ও ভাষানটেক এলাকার ঠিকাদারী,ফুটপাতে অবৈধ দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি, কিশোরগ্যাং এবং মাদক বানিজ্যও রয়েছে তাদেরই নিয়ন্ত্রনে।
দখলের কৌশল: ভয়, প্রতারণা ও প্রভাব:
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রথমে তারা জমির মালিকদের ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখায়, পরে নিজেরাই ‘দখলে থাকা’ প্রমান করে দলিলপত্র তৈরি করে। অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় কিছু অসাধু দালাল ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে দখলের পরিকল্পনা। তাদের রোষানলের স্বীকার, ভুক্তভোগী বেলায়েত হোসেন প্রতিবেদককে বলেন, আমি একজন চাকুরীজিবী। আমি দীর্ঘদিন যাবৎ ভাষানটেক থানাধীন পশ্চিম ভাষানটেক প্লট নং- ৪০/২/ এফ ক্রয় সুত্রে মালিক হয়ে ভোগদখলে আছি। বেশ কিছুদিন ধরে সালমা ভান্ডারী, লিমা, নুর জাহান নুরী, মো: মজিবর রহমান, মো: সাগরসহ উক্ত চক্রটি কিলার ইব্রাহিমের ছত্রছায় বসবাস করে, এবং তার আদেশ নির্দেশ পালন করে,তারা কিছুদিন পূর্বে +৪৮৭৩২২৩১৬৭৫ নম্বর হইতে আমার ব্যাবহৃত ০৯৭১১-২৬৯৭৭৩ নম্বরে হোয়াট্সঅ্যাপে ফোন করে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে আমার নিকট ৩০,০০,০০০/-(ত্রিশ লক্ষ) টাকা চাঁদা দাবী করে। আমি তাদের চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে তারা আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়। আমাকে নানা প্রকার হুমকি প্রদান করে এবং আমার ক্রয়কৃত প্লট-টি জোরপূর্বক দখল করবে বলে জানায়। উক্ত ঘটনার সূত্র ধরে গত ২৮/০২/২০২৪ ইং তারিখে রাত অনুমানিক ২.২০ ঘটিকায় উল্লেখিত চক্রটি ও অজ্ঞাত ২০/২৫ জন সন্ত্রাসী রড,লাঠি,দা, কুড়ালসহ আমার বাসায় এসে ভয়াবহ হামলা চালায় এবং প্রমান লোপাটের উদ্দেশে ০৪ (চার) টি সিসি ক্যামেরা ভাংচুর করে। আমার বাসার ভাড়াটিয়ারা তাদেরকে বাধা দিলে ফজলুল করিম ও মো: সাব্বির নামের দুই ভারাটিয়াকে ব্যাপক মারধর করে। এছাড়া অন্যান্য ভাড়াটিয়াদের দুই একদিনের মধ্যে বাসা ছেড়ে দেয়ার জন্য বলে অন্যথায় প্রানে মেরে ফেলার হুমকি প্রদান করে। ওই রাতে সন্ত্রাসীরা আমার বাসায় প্রায় ১৫,০০০০০/-(পনের লক্ষ) টাকার মালামাল লুটপাট করে ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে।
ভুক্তভোগী বেলাযয়েত হোসেন আরও বলেন, এসব সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের কারণে প্রতিটা মুহূর্তে আতঙ্কে আছি। না জানি কখন কি হয়ে যায়! ইতিপূর্বে তারা বিভিন্ন মাধ্যমে আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে কয়েকবার। আর এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক অভিযোগ দিয়েও কোন সুরাহা মেলেনি। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৫ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর বরাবরেও সুষ্ঠু বিচার চেয়ে আবেদন করেছি এবং মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মহোদয়, এমন কি বর্তমানে বিএনপি’র সিনিয়র নেতাদের কাছেও ও অভিযোগ দিয়েছি। জানিনা শেষ পর্যন্ত কপালে কি আছে?
অপরদিকে কাফরুল থানাধীন, ৫৫/৯/১- এ ও ৫৫/৯/১-ই হোল্ডিং (ইমান নগর, পূর্ব বাইশটেকি,কাফরুল) সমিতির বাড়ির সামনে ৩.১৫ একর জমির মালিকানা বদলে গেছে রাতারাতি। পুরাতন সাইনবোর্ড খুলে দেয়া হয়েছে নতুন সাইনবোর্ড। কোনটা আসল কোনটা নকল বোঝা বড় দ্বায়। উভয় সাইনবোর্ড-ই বায়না সুত্রে মালিক। পূর্বে এখানে ছিলো নবনিবাস প্রপার্টিজ লিমিটেড নামের একটি সাইনবোর্ড। তবে বর্তমানে এখানে যে সাইনবোর্ডটি দেয়া হয়েছে তাতে বায়না সুত্রে জমির মালিক জামাল আহমেদ গং।
ওই সাইনবোর্ডটির বায়নাকৃত জমির তফসিল যথাযথ তুলে ধরা হলো:
জেলা-ঢাকা, থানা ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিস মিরপুর অধীন ঢাকা কালেক্টরীর তৌজিভূক্ত। মৌজা “সেনপাড়া পর্বতা”। জে এল নম্বরঃ সি এস ২২০, এস এ ৯৯, আর এস ২৫, ঢাকা সিটি জরিপে ১৭ নং। খতিয়ান নম্বর সি এস ৫৬৩, আর এস ৩৪০৭, আর এস মিউটেশন ৮২৮৩ নং খতিয়ানের ২৬/২১ নং জোতভূক্ত, ঢাকা সিটি জরিপ খতিয়ান ১৭০৮৬ নং ঢাকা সিটি মিউটেশন ২১৫৯৯ নং খতিয়ানের ৩০/২৪ নং জোতভূক্ত। দাগ নং সি এস ও এস এ ১১৭ নং, আর এস ৬৯৪২ নং ডাকা সিটি জরিপে ৯৬৪৪ দাগ। যাহার চৌহন্দি: উত্তরে: রাস্তা, দক্ষিনে: রাস্তা, পূর্বে: রাস্তা ও পশ্চিমে: একই দাগের জমি।
এবার প্রশ্ন হলো পূর্বের এবং বর্তমানের দুটি সাইনবোর্ডে বর্ণিত তফসিল কিন্তু একই, শুধু বদলে গেছে মালিক। আর এই মালিক পরিবর্তন হতে পরিবর্তন হতে হয়েছে সরকার। সরকার পতনের পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থানে এভাবেই মালিকানা বদলে গেছে।
খোজ নিয়ে জানা যায়, কাফরুল থানা বিএনপির সাবেক সাধারন সম্পাদক জনি দেওয়ানের নেতৃত্বে এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের তত্ত্বাবধানে ৩.১৫ একর জমির উপর উঠেছে নতুন সাইনবোর্ড। এছাড়া ৫৫/৯/১- এ ও ৫৫/৯/১-ই হোল্ডিং এবং হান্নান মিয়ার ৮ তলা বাড়ির (ইমান নগর, পূর্ব বাইশটেকি,কাফরুল) অর্ধেক যায়গার মালিকানা দাবী করে জোরপূর্বক লাল কালি দিয়ে দাগটেনে দেয় যা এখোনও দৃশ্যমান।
এবার অনুসন্ধান করতে হবে আসলে এই জমির প্রকৃত মালিক কে বা কারা?
এ বিষয়ে আরও খোজ খবর নিতে জামাল আহম্মেদ গংদের বর্তমান সাইনবোর্ডে দেয়া মোবাইল নাম্বারে কল দিলে জামাল আহম্মেদ বলেন, তারা নবনিবাস প্রপার্টিজ এর কাছে স্ট্যাম্প বায়না করে জমি নিয়েছেন। কত টাকা বায়না করা হয়েছে এবং জমির পরিমান কতটুকু জানতে চাইলে তিনি হাসপাতালে আছেন বলে ফোন রেখে দেন।
নবনিবাস প্রপার্টিজ এর সাথে কথা না বলা পর্যন্ত ধোঁয়াশা কিš‘ থেকেই যায়!
নবনিবাস প্রপার্টিজ এর সাইনবোর্ডে দেয়া মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কেউ কল রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে আরিফ নামের এক একজন নিজেকে নবনিবাস প্রপার্টিজ এর ডাইরেক্টর অব ল্যান্ড পরিচয় দিয়ে প্রতিবেদককে বলেন, আমরাই জামাল আহম্মেদ গংদের কাছে বায়না নিয়ে ১০ কাঠা জমি দিয়েছি। অপনারা নিজেরাই তো এখোনও এই জমির পরিপূর্ণ মালিক নন, কারণ আপনারাও তো বায়না সুত্রে মালিক, তাছাড়া এই জমির প্রকৃত মালিক কে? প্রকৃত মালিকের কাছ থেকে নবনিবাস প্রপার্টিজ কত টাকা বায়না দিয়ে কত সালে এই জমি নিয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাবে আরিফ বলেন, এই জমির প্রকৃত মালিক আউয়াল সাহেব,আমরা ২০১৩ সাল থেকে জমিটি নেয়ার চেষ্টায় ছিলাম কিন্তু দামদর মেলেনি এতদিন, ২০২২ সালে এসে সবকিছু ঠিক হয়েছে। বায়নাকৃত টাকার অংক জানতে চাইলে কৌশলে এড়িয়ে যান তিনি। এছাড়া এই জমি নিয়ে আরও অনেক ঝামেলা আছে বলে জানান তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এলাকার একজন ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী বলেন, ভাই ১৭ বছর যাবৎ দেখছি, যার যখন ক্ষমতা আসে সেই তখন এই যায়গার মালিক হয়ে যায়। ওই যে উপরে দেখেন, নতুন সাইনবোর্ড ঝুলে গেছে আর এরাই এখন মালিক হয়ে যাবে।
ভয়াল বাস্তবতা: তবে কি তারা রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী?
স্থানীয় সূত্রমতে, চক্রটির আছে একটি শক্তিশালী ‘সুরক্ষা বলয়’, যা প্রশাসনের ভেতরে-বাইরের কিছু প্রভাবশালী মহল এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ টু-শব্দটি করারও সাহস পায় না ।
স্থানীয় জনগণের দাবি:
অবিলম্বে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হোক।
দখলদারদের নাম ও তালিকা প্রকাশ করা হোক।
রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ হোক।
প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হোক।
দলিল যার জমি তার নিশ্চিত করা হোক।
জমি ক্রয়-বিক্রয় ও বাড়ি নির্মাণসহ সকল ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি বন্ধ করা হোক।
ভাষানটেক-কাফরুলে দখলদারদের হাতে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র যদি নিরপেক্ষ ও কঠোর পদক্ষেপ না নেয়, তবে এর দ্বায় একদিন কেবল স্থানীয় প্রশাসনের উপরই নয় পুরো ব্যবস্থার উপরই আসবে।