আরিফ হোসাইন বরগুনাঃ
বরগুনার একটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অননুমোদিত ছুটি ভোগ, ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে।
বরগুনার বেতাগী উপজেলার ফুলতলা নুরুন্নেছা জুনিয়র গার্লস স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক মোঃ মজিবর রহমান গত মাস ধরে একটানা অননুমোদিত ছুটি ভোগ করে আসছেন। ২৪ সালে সরকারের পটপরিবর্তনের পর থেকে প্রধান শিক্ষক
নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকেন না, পাঠদান কার্যক্রমে ব্যাপক অনিয়ম করেন এবং ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিভিন্ন পদে নিয়োগ প্রদানের কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ বছরে মাত্র দুইদিন কর্মস্থলে উপস্থিত জনৈক শিক্ষকের ৫০ পার্সেন্ট বেতন ভাতা পকেটস্থ করার অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষক মোঃ মজিবর রহমান নানা অজুহাতে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় স্থবিরতা নেমে এসেছে। শুধু তাই নয়, প্রধান শিক্ষক মোঃ মজিবর রহমান কাল্পনিক পদ দেখিয়ে ভুয়া নিয়োগ নিয়োগে প্রতি পদের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা স্থানীয় শিক্ষিত নারী পুরুষদের নিকট থেকে আদায় করে প্রতারণা করার কথাও জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি বলেন, এটা যে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তা সাইনবোর্ড না থাকলে কারোরই বোঝার উপায় নেই। ১৯৮০ সালে স্থাপিত এই বিদ্যালয়ের অবকাঠামো নাজুক অবস্থায় পড়ে আছে। শিক্ষার পরিবেশ এখানে নেই বললেই চলে। সম্প্রতি বিবিচিনি ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক বরাদ্দকৃত দুই লাখ টাকা দিয়ে বর্তমান ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কয়েকটি চেয়ার, টেবিল ও বেঞ্চের ব্যবস্থা করেছেন।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানান, প্রধান শিক্ষকের অব্যবস্থাপনা, অর্থ আত্মসাতের মানসিকতা, কর্মদিবসের সিংহভাগ অনুপস্থিতি ইত্যাদির কারণে শিক্ষা কার্যক্রম স্থবিরতার মুখে পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষক বলেন, প্রধান শিক্ষক কাল্পনিক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্থানীয় কয়েকজনের নিকট থেকে পাঁচ লাখ করে টাকা নিয়েছেন। চাকরি দিতে না পারায় চাকরিপ্রার্থীরা তাদের টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করলে প্রধান শিক্ষক মোঃ মজিবর রহমান স্কুল ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, আঃ আলিম নামে জয়পুরহাট জেলার স্থায়ী বাসিন্দা এখানে শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন। প্রধান শিক্ষককে বিশেষ সুবিধা দেয়ায় বছরে একবার বিদ্যালয়ে হাজির হয়ে বারো মাসের স্বাক্ষর একদিনে দেন। চলতি বছরে হাজিরা খাতায় ঐ শিক্ষকের স্বাক্ষরের জায়গা খালি রয়েছে।
একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক মোঃ আমীরুল ইসলাম দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, বিদ্যালয়ের নথিপত্র সরিয়ে ফেলা, বিদ্যালয়ে অব্যাহত অনুপস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে প্রধান শিক্ষক মোঃ মজিবর রহমানের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১৩ আগস্ট বেতাগী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।
দায়েরকৃত সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়, ফুলতলা নুরুন্নেছা জুনিয়র গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক যোঃ মজিবর রহমান, পিতা- আঃ মজিদ হাওলাদার, মাতা- রেহেনা আক্তার, গ্রাম চামটা, ডাকঘর চামটা, উপজেলা বাকেরগঞ্জ, জেলা- বরিশাল। গত ১৫ মে, বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা ১০মিনিটের সময় বিদ্যালয়ের সকল নথি নিয়ে বিদ্যালয় থেকে তার নিজ বাসায় অবস্থান করছেন। তার কাছে বারবার অনুরোধ করে নথিপত্র চাওয়া হলেও তিনি কোন নথি দিতে বাধ্য নয়। এর ফলে বিদ্যালয়ের কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে এবং নথিগুলো বিদ্যালয়ে ফেরত পাওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতিসমূহ ও স্কুলে না আসার কারণসমূহ হলো- ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক আমার সংবাদ ও দৈনিক সাগরকুল পত্রিকার মাধ্যমে একটি জুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে যার পদের নাম ছিল “কম্পিউটার ল্যাব অপাটের” এই পদের জন্য তিনি দুইজন ব্যক্তির নিকট থেকে মোট দশ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন। সেই ২জন ব্যক্তি হচ্ছে- মোঃ সৈয়দ সোহরাব হোসেন, পিতা মৃত- সৈয়দ মুনসুর আলী, সাং- ফুলতলা, ডাকঘর-ফুলতলা, উপজেলা- বেতাগী, বরগুনা। এর কাছ থেকে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে ৫,০০০০০ (পাঁচ লক্ষ) টাকা কেন। মোঃ মজিবার হাওলাদার, পিতা মৃত মোঃ মোসলেম আলী হাওলাদার, গ্রাম- ফুলতলা, ডাকঘর ফুলতলা, উপজেলা- বেতাগী, বরগুনর কাছ থেকেও ৫,০০০০০ (পাঁচ লক্ষ) টাকা দেন। এখন তারা টাকা চাওয়ারে তিনি স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। পূর্বেও তিনি তিনটি নিয়োগ দিয়ে তাদের কাজ থেকে ১৩,০০০০০ (তের লক্ষ) টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এনটিআরসিএ’র তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আসা মোঃ আব্দুল আলীম- সহকারী শিক্ষক-গণিত তাকে দীর্ঘদিন ধরে বিনা কারণে ছুটিতে রেখে তার কাছ থেকে বেতনের অর্ধেক টাকা কমিশন খাচ্ছেন।
একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির নির্ধারিত নীতিমালা উপেক্ষা করে তিনি নিজস্ব পছন্দমতো নিয়োগ দিয়েছেন। এসব নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের তথ্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়কে নিজের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। নিয়মিত উপস্থিত না থেকেও বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। তিনি অনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনায় খুব পটু।”
এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষক মোঃ মজিবর রহমান মুঠোফোনে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, স্থানীয় একটা চক্র তিলে তিলে গড়া প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমি অসুস্থতাজনিত ছুটি ভোগ করছি। স্থানীয় ঐ চক্রটি লাখ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছে। চাঁদা না দেয়ায় আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বিদ্যালয়ে কোন ম্যানেজিং কমিটি নেই। গত মাসের ২৫ তারিখে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে।
এব্যাপারে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন জানান, প্রধান শিক্ষক মোঃ মজিবর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার আলোকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঐ কমিটির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে