শরিফা বেগম শিউলী,স্টাফ রিপোর্টার
আওয়ামী লীগের ক্যাডার ও ইসকনের অর্থদাতা সাব-রেজিস্ট্রার রিপন চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ও ঘুস নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পাওয়া রিপন হত্যাচেষ্টা মামলার আসামিও। বর্তমানে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় কর্মরত। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেন তিনি। ঘুস লেনদেনের ভিডিওতে দেখা যায়, মোহরার মশিউর রহমান টাকা গুনে গুনে সাব-রেজিস্ট্রার রিপনকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। তার ঘুসবাণিজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং তাকে অপসারণ দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে দলিল লেখক সমিতি।
দলিল লিখতে আসা আকবর আলী, মতিয়ার রহমান ও তোজাম্মেলসহ এলাকার লোকজন জানান, সাব-রেজিস্ট্রার রিপন মণ্ডল রেজিস্ট্রি অফিসে নির্দিষ্ট একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এর মাধ্যমে দলিল লিখতে আসা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সরকারি ফি ছাড়াও বিভিন্ন খাত দেখিয়ে নির্দিষ্ট অঙ্কের ঘুস নেন। এরপর তিনি দলিলে সই করেন। কমিশন না পেলে দলিলে নানা সমস্যা দেখিয়ে আটকে রাখেন।
তারা আরো বলেন, কোন দলিলে কত টাকার চালান বা সরকারি ফি দিতে হয়, গ্রামের মানুষ তা জানেন না। সাব-রেজিস্ট্রারের পক্ষে দলিল লেখকরা যে হিসাব দেন, সেই অনুযায়ীই টাকা জমা দিতে হয়। এভাবে প্রতি দলিলে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বেশি নেওয়া হয়। প্রতিদিন ৩০-৪০টি দলিল সম্পাদন হয়।
সাব-রেজিস্ট্রার একাই পান ৪০-৫০ হাজার টাকা। টাকাগুলো তিনি তার মোহরার মশিউর রহমানের হাত দিয়ে নেন। এমন একটি ডিডিও সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে।
তারা আরো বলেন, হিসাবের চেয়ে কম টাকা দিলে কাগজপত্রে সমস্যা দেখান। টাকা বেশি দিলে কাগজের সমস্যা থাকলেও সেই দলিল সহজে রেজিস্ট্রি করে দেন সাব-রেজিস্ট্রার। দুর্নীতি ও অপকর্ম আড়াল করতে ইসকনের ব্যানারে রাজনৈতিক প্রভাব বিভার করার চেষ্টাও করেন রিপন।
দলিল লেখক মোয়াফিজার ও মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে একটু অনিয়ম-দুর্নীতি হয়, এটা সবাই জানে। ইতঃপূর্বে গঙ্গাচড়ার সাব-রেজিস্ট্রার রিপন চন্দ্র মণ্ডলের রমরমা ঘুসবাণিজ্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলিল লেখকরা কলমবিরতি পালন করেছেন। উপদেষ্টার কাছে অভিযোগও করা হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন ভয়ে তার বিরুদ্ধে অনেকে কথা বলতে চান না। কারণ, তার দুর্নীতির বিপক্ষে কথা বললে লাইসেন্স বাতিলসহ অন্যান্য হুমকি দেওয়া হয়। এ কারণে সবাই চুপ করে আছেন।
তারা আরো বলেন, সাব-রেজিস্ট্রার রিপন ও মোহরার মশিউর রহমানের টাকা লেনদেনের ভিডিও ভাইরাল হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুদক বা গোয়েন্দা সাস্থার লোকজন তদন্ত করলে সাব-রেজিস্ট্রারের অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য পাওয়া যাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন দলিল লেখক জানান, সাব-রেজিস্ট্রার রিপন আওয়ামী লীগের সক্রিয় ক্যাডার। তিনি বিতর্কিত ধর্মীয় সংগঠন ইসকনের অর্থদাতা এবং বিএনপি নেতা হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি।
সূত্র জানায়, দিনাজপুরের বীরগঞ্জে সাব-রেজিস্ট্রার থাকাকালে রিপনের বিরুদ্ধে ঘুস দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। জেলা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অফিসে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও
তদন্ত করা হয়েছিল। রিপন রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডলের ভাগনে। এ কারণে তার সব দুর্নীতি-অনিয়ম চাপা পড়ে। ফের তদন্ত করলে তার সব অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পাওয়া যাবে।
স্থানীয়রা জানান, গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তার ঘুস লেনদেনের ভিডিও প্রকাশ পেলেও তিনি এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। তার বিরদ্ধে বললে দলিল লেখকদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে-এ কারণেই উদ্বিগ্ন দলিল লেখকরা।
গঙ্গাচড়া দলিল লেখক সমিতির সভাপতি চান সরকার বলেন, মৌজা অনুযায়ী দলিল সম্পাদনের টাকা কম-বেশি হয়। যে মোল্লার রেট বেশি, যেখানে বেশি টাকার চালান জমা দিতে হয়। যে মৌজার রেট কম, সেখানে কম দিতে হয়। চালান ছাড়াও কাগজপত্রাদি ও লেখার জন্য টাকা নেওয়া হয়। সব মিলিয়ে জমিগ্রহীতাদের হিসাব দেওয়া হয়। এ কারণেই অনেকে টাকা বেশি নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করে থাকেন।
টাকা লেনদেনের ভিডিও সম্পর্কে মোহরার মশিউর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, টাকা গোনার সময় কে ভিডিও করেছে, সেটি আমার জানা নেই। এটি কিসের টাকা, কোন টাকা-সেটা আমরাই জানি। এ বিষয়ে বেশি জানতে চাইলে অফিসে আসুন। সামনাসামনি কথা বলব বলে তিনি ফোন কেটে দেন।
বিএনপি নেতা মনিরুল ইসলাম মিন্টু জানান, গত বছরের ১৫ নভেম্বর রাত সোয়া ৮টার দিকে আওয়ামী লীগের একটি মিছিন রংপুর মহানগরীর জাহাজ কোম্পানি মোড় থেকে স্টেশন রোডের দিকে রওনা দেয়। মিছিল থেকে বদরগঞ্জ উপজেলার জিয়া মঞ্চ’র সদস্য সচিব লিয়াকত উল্লাহ লুসানের ওপর আকস্মিক হামলা চালানো হয়। সাব-রেজিস্ট্রার রিপনসহ ১০-১২ সন্ত্রাসী জামানকে বেধড়ক মারধর করে। চাপাতি দিয়ে কোপার এবং পরে তাকে নূর সুপার মার্কেটের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে।
তিনি বলেন, পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে রিপনসহ ২৬ জনের নাম উল্লেখ্য করে এবং ২৫৯-৩০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে কোতোয়ালি থানায় হত্যাচেষ্টা মামলা করেন লুসান।
জেলা বিএনপির সদস্য ও বদরগঞ্জ পৌর বিএনপির সভাপতি কমল লোহানী জানান, জিয়া মঞ্চের নেতা লুসানকে হত্যাচেষ্টার মামলার আসামি কীভাবে বহাল তবিয়তে সরকারি চাকরিতে থাকে বিষয়টি দেখার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানান তিনি।
এ বিষয়ে জেলা রেজিস্ট্রারের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে জেলা প্রশাসক রবিউল ফয়সালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
তিনি জানান, ‘সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে থাকে। এ বিষয়মূল্যে আমরাও শুনি। বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের, যা জেলা রেজিস্ট্রার দেখে থাকেন। তাই সরাসরি আমাদের কিছু করার নেই। তবে এ বিষয়ে আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।