মোহাম্মদ জাকারিয়া/ সোহাগ হাওলাদার
সার্টিফিকেট বাণিজ্য ও অতিরিক্ত ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে ৬০ জন করে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করার নিয়ম থাকলেও সেখানে ভর্তি করা হচ্ছে প্রতি ডিপার্টমেন্টেই অতিরিক্ত ছাত্রছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এভাবেই ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকেও কোন তোয়াক্কা করছে না এই প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চেয়ারম্যান মকবুল আহমেদ খান। ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৩ হাজারেরও বেশি ছাত্র ছাত্রীর কাছ থেকে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের ফি বাবদ প্রায় ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ছাত্রছাত্রী প্রায় ২২ হাজার।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তোয়াক্কা না করেই অতিরিক্ত ছাত্রছাত্রী ভর্তি ও সার্টিফিকেট বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য সমাবর্তন করতে পারছে না এই বিশ্ববিদ্যালয়টি।বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সুত্র জানায়, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ডিপার্টমেন্টে ৬০ জন করে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করার নিয়ম থাকলেও সরেজমিনে দেখা যায়, এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে ৫০০ থেকে ৬০০ জন অতিরিক্ত ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়েছে। অপরদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও সার্টিফিকেট বাণিজ্যের বিষয়টি নজরে আসে মঞ্জুরি কমিশনের। যার কারণে ২০২২ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পেয়ে গত ২০২২ সালের ২৭ জুন ৭টি শর্ত উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটিকে নির্দেশনা প্রদান করে। এতে বলা হয়, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর বিরুদ্ধে বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামসহ অন্যান্য কয়েকটি প্রোগ্রামে কমিশন অনুমোদিত আসন সংখ্যার বিপরীতে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়টি প্রমাণিত হয়। কমিশনের অনুমোদিত আসন সংখ্যার অতিরিক্ত শিক্ষার্থীদের ক্রেডিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিশনের তত্ত্বাবধানে হস্তান্তর করতে হবে। সকল শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল (প্রমাণক যেমন একাডেমিক ট্রান্সকৃপ্ট ইত্যাদি) কমিশনে প্রেরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ভর্তি অযোগ্যদের ভর্তি বাতিল করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার এ এফ এম হোসাইনকে অতিসত্বর চাকরী হতে অপসারণপূর্বক এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনে অভিজ্ঞতা আছে এমন একজনকে রেজিস্টার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করতে হবে। কমিশন অনুমোদিত আসন সংখ্যার বিপরীতে কোন প্রোগ্রামে শুরু হতে অতিরিক্ত যতজন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে, সে বাবদ গৃহীত সমুদয় অর্থ কমিশনের নিকট জমা প্রদান করতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ৪৪ (১) ধারা অনুসরনপূর্বক কমিশনকে অবহিত করতে হবে। উক্ত সাধারণ তহবিলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংগৃহীত বেতন, ফি ও অন্যান্য উৎস হতে প্রাপ্ত অর্থ জমা করে ব্যয় করবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ৪৪(১), (২) ও (৩) অনুসরণপূর্বক পরবর্তী সেমিস্টার হতে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে হবে। সেই সঙ্গে কমিশন প্রণীত ইউনিক আইডি নম্বর সংক্রান্ত নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে যথাযথভাবে দ্রুত পালনপূর্বক কমিশনকে অবহিত করতে হবে।২০২২ সালের ১৪ মার্চ সরকার কর্তৃক সাময়িক অনুমতি প্রাপ্ত স্থায়ী ক্যাম্পাসে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ৮ ধারা অনুযায়ী সনদপত্রের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় আবেদন দাখিল করতে হবে। পরবর্তী সেমিস্টার হতে সকল প্রোগ্রাম ডুয়েল সেমিস্টার ভিত্তিতে পরিচালনা করবে মর্মে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা কমিশনের বরাবর প্রেরণ করতে হবে।
বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এমন নির্দেশনা প্রদানের পরেও শুধুমাত্র ইউনিভার্সিটির রেজিস্টার এ এফ এম হোসাইন-কে অপসারণ ছাড়া আর কিছুই বদলায়নি ওই বিশ্ববিদ্যালয়টির।অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ লাগামহীন অনিয়মের কারণে অদ্যবধি সমাবর্তন অনুষ্ঠান করতে পারেনি কতৃপক্ষ। যার ফলে মূল সনদ হাতে পায়নি হাজার হাজার শিক্ষার্থী। মূল সনদ না থাকার কারণে উচ্চশিক্ষা অর্জনে বিদেশে যেতে না পেরে হতাশায় ভুগছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীরা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সমাবর্তন চাই, সনদ চাই নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে তাদের শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন হতাশা ও দুর্দশার কথা তুলে ধরে একের পর এক অভিযোগ তুলছে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর বিরুদ্ধে।এছাড়া ২০১৯ সালে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের নামে তিন ক্যাটাগরিতে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে ফি নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ- ৬ হাজার টাকা, বি- ৭ হাজার ৫০০ টাকা ও সি- ১ হাজার ৫০০ টাকা। শুধু সমাবর্তন অনুষ্ঠানের ফি বাবদ ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তুলে নিয়েছে প্রায় ৮ কোটি টাকা। যে টাকা আজ পর্যন্ত কোন ছাত্র-ছাত্রীকে ফেরত দেয়নি এবং সমাবর্তন অনুষ্ঠানও করেনি।শিক্ষর্থীরা জানিয়েছেন, সমাবর্তন একজন অনার্স সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীর জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া। আমরা যারা অনার্স সম্পন্ন করেছি সবাই সমাবর্তন চাই। এটা পাওয়া আমাদের ন্যায্য অধিকার। ইতিপূর্বে ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল আমাদের প্রথম সমাবর্তন তারিখ সিদ্ধান্ত হয়। ওই সময় শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনও সম্পন্ন করা হয়েছিলো। কিন্তু সে সময় করোনা পরিস্থিতির জন্য সমাবর্তন বাতিল হয়ে যায়। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হওয়ার পর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চাকরি চলে যায়। যার ফলে ২০১৮ সালে সিভিল বিভাগে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়ে লেখালেখি হয়। যা নিয়ে ইউজিসি তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং শাস্তি সরূপ সে সময়ে দায়িত্ব পালনকারী রেজিস্ট্রারকে অব্যবহিত দিতে নির্দেশ দেয়। অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির সমস্যার সমাধান করতে বলে। সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সমাবর্তন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর সমস্যার কিছুটা সমাধান করে সমাবর্তন করার অনুমতি চেয়ে ইউজিসিতে চিঠি পাঠানো হয়েছিলো। সেখান থেকে শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তর হয়ে রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে কোন প্রতিউত্তর পাওয়া যায়নি।শিক্ষার্থীরা আরো জানান, গত নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভার্সিটির ভাইস চেয়ারম্যান মকবুল আহমেদ স্যারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমরা কথা বলেছি। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, আগামী মার্চ নাগাদ সমাবর্তনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইউজিসিতে আবারো চিঠি পাঠানো হয়েছে। খুব দ্রুতই সব সমস্যার সমাধান করে সমাবর্তন করবেন। আজও পায়নি। আমরা কবে নাগাদ সমাবর্তন পাবো তা আমাদের নিশ্চিত করেননি। গত ২৬ অক্টোবর তারিখ দেন। তাও হয়নি। সেটাও পিছিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পাবলিক ফেসবুক গ্রুপে ভার্সিটির বিরুদ্ধে লিখতে হচ্ছে। যা আমাদের জন্য আরো বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ করে বলেন, আমরা ভাবছিলাম ভার্সিটি এবার ভালো হয়ে গেছে। দেরিতে হলেও বোধোদয় হয়েছে, কিন্তু, না। সেই ধারণাও ভুল। মূলত এডমিশন বাড়ানোর জন্যে মাঝের রেজিস্ট্রেশনটা একটা আইওয়াশ ছিল। ওই সময়েই টানা কিছু ভার্সিটির কনভোকেশন হয়ে গেলো। তাই তখন শিডিউল পাচ্ছি না বলাটা যুক্তি সংগত ছিলো না। কোভিড এক্সকিউজ আর কত বছর। আবার নতুন যারা এডমিশন নিতে আসে তারাও হয়তো এ কথা খাচ্ছিলো না। ইউরপিয়ান ইউনিভার্সির সনদ বানিজ্য কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। কারণ মালিক নিজেই তার অফিসারদের নিয়ে এই বানিজ্য চালান।এসব অনিয়ম অভিযোগের বিষয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর ভাইস চ্যান্সেলর মকবুল আহমেদ খান বলেন, এ রকম অনেক সাংবাদিক আছে, যারা এসে ১০-২০ হাজার চায়। কিন্তু আমি দেয়নি। তারাই আমার বিরুদ্ধে কথা বলে। কারণ আমি সত্যের সাথে আছি। ন্যায়ের পথে কাজ করি, আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমার একহাতে বন্দুক আরেক হাতে কলম। আমি কলম দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি। আর তাতে কাজ না হলে বন্দুক দিয়ে কাজ করি। পৃথিবীতে এমন কোন মায়ের পুত নাই যারা বন্দুক ভয় না পায়। সার্টিফিকেট বাণিজ্য ও আসন সংখ্যার বিপরীতে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার এখানে কোন সার্টিফিকেট বাণিজ্য হয় না। তাছাড়া আগে আমাদের ক্যাম্পাস ছোট ছিলো। এখন আমাদের ক্যাম্পাস নিজস্ব ও আয়তনে অনেক বড়। তাই বেশি ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি নেয়া হয়, তাতে আবার অনুমতি লাগবে কিসের। এবিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে জানানো হয়েছে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। দুয়েকজন বিরুদ্ধে বলতেই পারে। তবে সঠিক নয়।প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজও সমাবর্তন হয়নি এবং ছাত্র-ছাত্রীরা মূল সনদ পাইনি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই মাসের ২৬ অক্টোবর আমরা সমাবর্তন অনুষ্ঠান করব।এ বিষয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান চাঁদপুর ১ আসনের সংসদ সদস্য ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর এর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।