নিজস্ব প্রতিবেদক:
জাহাঙ্গীর আলম। পুলিশ কনস্টেবল। বিপি নম্বর ৮৭০৬১১৭৮৬১। বাড়ি শরীয়তপুর সদর উপজেলার ভাষানচর গ্রামে। ২০০৬ সালে পুলিশে যোগ দেন জাহাঙ্গীর। বর্তমানে তার চাকরির বয়স ১৮ ছুঁই ছুঁই। তবে চাকরি জীবনের ১২ বছরই তিনি ঢাকা জেলার ধামরাই থানায় কর্মরত। এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন। কীভাবে তিনি একই থানায় এত বছর চাকরি করেন? জাহাঙ্গীর আলম মূলত ধামরাই থানার কম্পিউটার অপারেটর। থানার ড্রাফটিং, এজাহার, অভিযোগপত্র, সাধারণ ডায়েরি, আপোষনামা, ছাড়পত্র, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, চার্জশিট ড্রাফটিং, অফিসিয়াল চিঠিপত্র সহ যাবতীয় লেখালেখিই তার হাতে হয়। সেই সুবাদে থানার ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গেও সখ্য তার। এই সুযোগে নিজের পদকে কাজে লাগিয়ে অল্প সময়ে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। নিজের নামে থানার পাশেই কিনেছেন জমি।সম্প্রতি সেই জমিতে ৫ তলা বাড়ি নির্মাণ করে আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। এদিকে একজন পুলিশ কনস্টেবলের হঠাৎ উত্থানে থানার আশপাশের বাসিন্দারাও রীতিমতো অবাক। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, কনস্টেবল এত টাকা কোথায় পেলেন? কীভাবে তিনি রাজকীয় জীবনযাপন করেন। অভিযোগ রয়েছে, শুধু ঢাকায় নয়, জাহাঙ্গীর আলম নিজ গ্রামেও কয়েক বিঘা জমি কিনেছেন। মাঝেমধ্যেই তিনি গ্রামে ছুটে যান। জমি দেখভাল করেন। সেখানেও বাড়ি নির্মাণের তোড়জোড় করছেন। সম্পদ করেছেন শ্বশুরবাড়িতেও। জাহাঙ্গীরের শ্বশুরবাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার কোনা কালিহর গ্রামে। ধামরাই থানা সূত্রে জানা গেছে, কোটাবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের ব্লক রেইড চলার সময় শিক্ষার্থী, বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক মামলা দেয় পুলিশ। চলে গণগ্রেপ্তারও। ওই সময়ে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে মামলার এজাহার থেকে বেশকিছু আসামির নাম মুছে দিয়ে ধরা পড়ে যান জাহাঙ্গীর। পরে তাকে ধামরাই থানা থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে ঢাকা জেলা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়। ছাত্রজীবনে জাহাঙ্গীর আলম ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শরীয়তপুর পৌর ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন এই জাহাঙ্গীর। ২০০৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেলের অনুসারী ছিলেন। বর্তমানে তার পরিবার ইকবাল হোসেন অপুর রাজনীতি করেন। সাবেক সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপুর প্রভাব খাটিয়েই তিনি প্রায় ১০ বছর ধামরাই থানায় চাকরি করেছেন।অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২০ সালে ধামরাই থানা রোডের বরাতনগর লাকুড়িয়াপাড়া মৌজায় বিআরএস ৪৩৬১ নং খতিয়ানের ৪৬৫ নং দাগে ৪ শতাংশের একটি প্লট কেনেন জাহাঙ্গীর। ধামরাই থানায় দায়িত্বরত থাকা অবস্থায় তিনি এই প্লট কিনেন। প্লট নং ই-১৬। সরজমিন গেলে ওই এলাকার স্থানীয়রা জানান, বরাতনগরে প্রতি শতাংশ জমির দাম স্থানভেদে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকার উপরে। সেক্ষেত্রে ৪ শতাংশ জমির দাম প্রায় ৫০ লাখ টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ওই প্লটে আবাসিক ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন জাহাঙ্গীর। ১০ তলা ফাউন্ডেশন ভবনের ৫ তলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। এখন ফিটিংসের কাজ চলছে। সূত্র জানায়, এর মধ্যেই বাড়ির পাশের ৩ কাঠার খালি প্লটটিও কেনার চেষ্টা করছেন। জানা গেছে, এমনিতেই পুলিশের নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের বেহালদশা। কনস্টেবলদের সামান্য বেতনে সংসার চালাতে হাঁসফাঁস অবস্থা। সেখানে জাহাঙ্গীরদের মতো কনস্টেবলদের কোটি টাকার বাড়ি, গাড়ি ও সম্পদ অর্জন দেখে পুলিশের অনেক সদস্যই অবাক। আব্দুল বাসেত রানা নামের এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল বলেন, একজন কনস্টেবলের মূল বেতন সাড়ে ৯ হাজার টাকা। অন্যান্য সুবিধাসহ তারা মোট ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা পান। এই টাকা দিয়ে প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়। পরিবার চালানো সম্ভব না। নিজের পকেট খরচ চলে না। একজন গার্মেন্টস কর্মীর চেয়েও একজন কনস্টেবলের বেতন কম। সেখানে কোটি টাকার বাড়ি করা অসম্ভব। এটা অসৎ পথ অবলম্বন না করলে মোটেও সম্ভব না। জানা গেছে, অনিয়ম ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে কয়েক বছর আগে তাকে মুন্সীগঞ্জ পুলিশ লাইনে বদলি করা হয়। সেখান থেকে কয়েক মাস পরই তদবির করে আশুলিয়া থানায় আসেন। পরে আশুলিয়া থেকে ৯ মাস পর বদলি হয়ে পুনরায় ধামরাই থানায় চলে আসেন। বাড়ি ও জমির বিষয়ে জানতে চেয়ে পুলিশ কনস্টেবল জাহাঙ্গীর আলমকে ফোন করা হলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমি বরাতনগরের জমিটি অনেক আগে কিনেছি। এখন সেখানে একটি বাড়ি নির্মাণ করছি। এটা আমার অনেক কষ্টের টাকা। অল্প অল্প করে সঞ্চয় করে বাড়িটি করেছি। এখানে আমার স্ত্রীও সহায়তা করছে। তবে টাকার উৎস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে এই কনস্টেবল উল্টো প্রশ্ন রেখে বলেন, আমি বাড়ি করেছি, এতে কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? আমি কি কারও ক্ষতি করেছি। কারও টাকা মেরে বাড়ি করেছি? চাকরি করি বলে আমরা কি কোনো বাড়ি-গাড়িও করতে পারবো না?